এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? কোন বিষয়টি সবার আগে সমাধান করা উচিত?
দুটি প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই অনেক কথাই বলবেন। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কারও বিষয়টি ভালো জানার কথা। যেমন তামিম ইকবাল। প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র তামিমের সামনে এ দুটি প্রশ্ন রেখেছিলেন। তামিমের উত্তর, ‘আমার কাছে মনে হয় যে আমাদের ফ্যাসিলিটিজ (অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা) নাই।’
প্রথম আলোর কার্যালয়ে উৎপল শুভ্রকে দেওয়া বিশেষ ভিডিও সাক্ষাৎকারে আড্ডার মেজাজে তামিম বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। নিজের ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য—এসব নিয়েও বেশ খোলামেলা কথা বলেন সাবেক এই ওপেনার।
আলাপচারিতার একপর্যায়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটে এ মুহূর্তের সমস্যার প্রসঙ্গ উঠেছিল। অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধার অভাবকে সামনে টেনে এনে তামিম বলেছেন, ‘একটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের যে ফ্যাসিলিটিজ দরকার হয় কিংবা বাংলাদেশের মতো দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার একটি (ক্রিকেট), যে ফ্যাসিলিটিজ থাকা উচিত, তার আশপাশেও নেই। পৃথিবীর তৃতীয়, চতুর্থ ধনী বোর্ডের যে ফ্যাসিলিটিজ থাকা উচিত, আমরা এর আশপাশেও নেই।’
তামিম বিষয়টি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করলেন, ‘ক্রিকেট দলের প্রতি ভক্তদের যে প্রত্যাশা, সেটা পূরণের জন্য যে ফ্যাসিলিটিজ দরকার, আমরা তার আশপাশেও নেই। আপনি মাঝারি মানের ক্রিকেটার হতে পারেন কিংবা মাঝারি মানের ব্যাটসম্যান হতে পারেন, সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে কিন্তু আপনি মাঝারি মান থেকে দুই ধাপ ওপরে উঠতে পারবেন।’
তামিম এরপর মুশফিকুর রহিমের উদাহরণ টানেন, ‘আমি কোনোভাবেই মুশফিকুর রহিমকে মাঝারি মানের ব্যাটসম্যান মনে করি না। আমার কাছে মনে হয় সে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। কিন্তু মুশফিকুর রহিমের আজ থেকে ১০–১২ বছর আগের ব্যাটিং আর এখনকার ব্যাটিংয়ে কিন্তু আকাশ–পাতাল পার্থক্য। সে কীভাবে হয়েছে? আমি দেখেছি, নিখাদ কঠোর পরিশ্রম ও নিবেদনের কারণে। একবার ভাবুন তো, আমাদের যদি অনুশীলনের জন্য সেরা সুযোগ–সুবিধা থাকত, তাহলে কী হতো?’
তামিম এরপর আরেকটি প্রসঙ্গ টানেন, ‘আমরা ৯০ শতাংশ বিষয় জাতীয় দলে এসে শিখেছি। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা না। এই যে পাওয়ার হিটিং কোচ বা এই কোচ, সেই কোচ আনা হচ্ছে—এগুলো তো অনূর্ধ্ব–১৯, অনূর্ধ্ব–১৭, অনূর্ধ্ব–১৫ তেই শিখে যাওয়ার কথা। জাতীয় দলে আসার পর এটা কেন করাতে হবে? পৃথিবীর সব ভালো ফ্যাসিলিটিজ পাওয়ার পরও আপনি ভালো ত্রিকেটার নাই হতে পারেন। এটার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু ওরা (খেলোয়াড়) যদি সঠিক সুযোগ–সুবিধা পায়, তাহলে ভালো ক্রিকেটার হয়ে ওঠার সুযোগটাও বাড়বে।’
তামিমের মুখে সমস্যাটা তো শোনা হলো। সমাধান কী? এই প্রসঙ্গে দেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান সামনে টেনে আনেন তাঁর নতুন সম্ভাব্য ভূমিকার বিষয়টি। সামনে বিসিবি নির্বাচনে তামিম অংশ নেবেন বলে এর আগে একটি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। উৎপল শুভ্রর সঙ্গে আলাপচারিতায় শুরুর দিকে সেই প্রসঙ্গও উঠেছিল। তামিম তখন বলেছেন, আপাতত বিসিবির পরিচালক হওয়া নিয়েই তিনি ভাবছেন। তবে সভাপতি হতে চাওয়ার বিষয়টিও তামিম সরাসরি অস্বীকার করেননি। আগে পরিচালক হয়ে তারপর ধাপে ধাপে এগোতে চান।
সমস্যার সমাধানে তামিম বোর্ডে দায়িত্বের বিষয়টি সামনে টেনে আনেন, ‘আমি যদি ক্রিকেট বোর্ডে আসি, সেটা অনেক উঁচু পদ হোক, বোর্ড পরিচালক হোক, আমি যদি ক্রিকেটের একটা–দুটো জিনিস এই চার বছরে করে দিয়ে যেতে পারি, যার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো এক্সিলেন্স সেন্টার।’ তামিম এটুকু বলে একটু থেমে বললেন, ‘আমার কাছে সবকিছুর বিশদ পরিকল্পনা আছে। আমি জানি না বোর্ড পরিচালক হতে পারব কি না, কিন্তু এই সাক্ষাৎকার শেষে আমি আপনাকে (পরিকল্পনা) দেখাব। কোথায় কতটুকু জমি, কী করতে হবে,সবকিছুর বিশদ পরিকল্পনা আছে। আমি যে জিনিসগুলোর স্বপ্ন দেখি, সেগুলো যদি করতে পারি, তাহলে শুধু ক্রিকেট নয়, অন্য খেলাগুলোকেও সাহায্য করতে পারব।’
তামিম যুক্তি দেন, ‘বাংলাদেশে যারা ভালো পর্যায়ের ক্রিকেটার, যেমন ধরুন অনূর্ধ্ব–১৯, অনূর্ধ্ব–১৭, এইচপি, একাডেমি, জাতীয় দল—আপনি তাদের কাছ থেকে বিশ্বের সেরা পারফরম্যান্স আশা করেন। রাস্তায় যারা বাদাম বিক্রি করেন, উনাদের জিজ্ঞেস করেন, উনারাও কিন্তু চায় বাংলাদেশ ভারতকে হারাক, পাকিস্তানকে হারাক। তারা সঠিক। তাদের এই আশা থাকাই উচিত। তাদের আশার কারণেই তো ক্রিকেটটা আজ এ জায়গায়। যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের কি খেলোয়াড়দের ওই ফ্যাসিলিটিজ দেওয়ার দায়িত্ব নেই, যেন ওই জায়গায় গিয়ে তাদেরও (খেলোয়াড়) চিন্তা এরকম হয় যে, আমরা এদের হারাব কিংবা ওটা করব। মিরপুর একাডেমিতে যদি অনুশীলন করেন তাহলে এসব চিন্তা কম আসবে, বল কোনদিক থেকে এসে মাথায় লাগবে সেই চিন্তা করতে হবে।’
তামিম এরপর খেলোয়াড়দের পাইপলাইনের প্রসঙ্গ টানেন। তাঁর দাবি, খেলোয়াড় যে একদম নেই তা নয়, বাংলাদেশের পাইপলাইনে খেলোয়াড় আছে। বয়সভিত্তিক দল ও লিগগুলো থেকে তাঁরা উঠে আসছে। খেলোয়াড় তুলে আনার বিষয়ে তামিমের যুক্তি, ‘আমরা বিশ্বের সবচেয়ে সফল মডেলটাই অনুসরণ করছি না। সেটা স্কুল ক্রিকেট। আজ থেকে ১৫–২০ বছর আগে যাঁরা ক্রিকেট খেলেছেন, তাঁরা জানেন নির্মাণ স্কুল কিন্তু ছিল। খুব জনপ্রিয় ছিল। নিশ্চয়ই মডেলটা তখন কাজে লেগেছিল। আমরা কেন এই জায়গায় গুরুত্ব দিইনি, আমি বুঝতে পারি না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক, প্রতিটি এলাকায় মাঠ থাকলে অন্তত দুটি করে একাডেমি আছে। ওরা বাচ্চাদের কী শেখাচ্ছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
তামিম এই জায়গায় গুরুত্ব দিয়ে আরও বলেন, ‘সব একাডেমি থেকে কয়েক শ কোচ হবে। সবাইকে তো আপনি চাকরি দিতে পারবেন না। কিন্তু সবাইকে নিয়ে তো একটা সেমিনার করতে পারেন, প্রতিবছর। এ মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেট কী টেকনিক ব্যবহার করছে, সেটা জানানো।’
তামিম বলে যান, ‘বেশির ভাগ ক্রিকেটার আসে গরিব পরিবার থেকে। ওদের তো মাস্কো কিংবা আরও বড় একাডেমিতে গিয়ে অনুশীলনের সুযোগ নেই। এই বাচ্চাগুলো যায় কই জানেন, উদাহরণস্বরূপ আবাহনীর মাঠ আছে, ওখানে অনেক একাডেমি আছে, মাসে এক শ–দুই শ টাকা দিয়ে শেখে। ওখানে যাঁরা ওদের শেখাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যে সঠিক পরামর্শটা তাঁদের দেওয়া। আমি আপনাকে এই দুই–তিনটি পয়েন্টই বললাম। আমার এই দুই–তিনটি পয়েন্টের বেশি আর কাজ করার ইচ্ছা নেই।’
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply