| |
ভিডিও
ads for promotions
/
মহাবিশ্বের অন্যতম রহস্য 'ডার্ক এনার্জি'

মহাবিশ্বের অন্যতম রহস্য 'ডার্ক এনার্জি'

নিউজ ডেস্ক: ফাতেমা

প্রকাশিত: 18 January, 2024

  • 17
মহাবিশ্বের 'ডার্ক এনার্জি'র রহস্যের সমাধান এখনো মেলেনি

 শতবছর  আগে নতুন একটা তত্ত্ব আবিষ্কার করে হইচই ফেলে দিয়েছেন গোটা বিজ্ঞানজগতে। সবার চোখে তিনি তখন তারকা বিজ্ঞানী। প্রায় এক দশক জোঁকের মতো লেগে ছিলেন এ তত্ত্বের পেছনে। রাত-দিন এক করে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯১৬ সালে পৌঁছান এর চূড়ান্ত ক্ষেত্র সমীকরণে। সে তত্ত্বকে এখন বলা হয় আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের অন্যতম নমুনা। তার নাম সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। বুঝতেই পারছেন কার কথা বলছি। তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন।

খ্যাতির উত্তাপ পোহাতে পোহাতে ১৯১৭ সালের দিকে নিজের প্রণয়ন করা সেই সমীকরণ সমাধান করতে গেলেন আইনস্টাইন। তাতে নিজেরই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হলো জার্মান এই পদার্থবিদের। কারণ, নিউটনের কাল থেকে শুরু করে তখনো পর্যন্ত বিশ্বাস করা হতো, মহাবিশ্ব স্থির। কিন্তু একি! তাঁর নিজের সমীকরণ বলছে উল্টো কথা! মানে সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণের সমাধান থেকে পাওয়া যাচ্ছে একটা গতিশীল মহাবিশ্ব। কিন্তু এ রকম হবে কেন? নিজের সমীকরণকে বিশ্বাস করতে পারলেন না আইনস্টাইন।

কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে ১৯৩১ সালে সস্ত্রীক বেড়াতে এসে জনসম্মুখে নিজের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হন আইনস্টাইন। বললেন, মহাজাগতিক ধ্রুবক ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। ১৯২১ সালে তোলা ছবি

এর একটাই অর্থ হতে পারে, সমীকরণে ভুল আছে—ভাবেন আইনস্টাইন। কাজেই তা সংশোধনের চিন্তা করলেন। সেটা করতে এতে ঢুকিয়ে দিলেন নতুন এক ধ্রুবক। সেটা কাজ করে মহাকর্ষের বিরুদ্ধে। মানে অ্যান্টিগ্র্যাভিটি। বাংলায় বলা যায়, প্রতিমহাকর্ষ বল। ধ্রুবকটা প্রকাশ করা হলো গ্রিক বর্ণ ল্যামডা দিয়ে। নামটাও দিলেন বেশ গালভারী—মহাজাগতিক ধ্রুবক বা কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট।ব্যস! তাতে পাওয়া গেল একটা কাঙ্ক্ষিত স্থির মহাবিশ্ব। মনে শান্তি ফিরে পেলেন আইনস্টাইন। কিন্তু তিনি জানতেন না, এই গোঁজামিলের জন্য অচিরেই দুঃখ করতে হবে তাঁকে। জানতেন না, অন্য বিজ্ঞানীরা একে তুলনা করবেন কুৎসিত হাঁসের ছানার সঙ্গে।

প্রায় এক দশক পর আইনস্টাইনের সাধের স্থির মহাবিশ্বকে স্রেফ ধসিয়ে দিলেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবল। তিনি তখন কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে। রাতের আকাশে অসংখ্য গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল, মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্যালাক্সি একটা আরেকটার কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। সরল কথায়, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ তা কোনোভাবেই স্থির হতে পারে না, বরং গতিশীল। ফুলেফেঁপে ক্রমেই বড় হচ্ছে আকারে-আকৃতিতে।

কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে ১৯৩১ সালে সস্ত্রীক বেড়াতে এসে জনসম্মুখে নিজের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হন আইনস্টাইন। বললেন, মহাজাগতিক ধ্রুবক ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

এই তো, এরপরই মহাজাগতিক ধ্রুবকের স্থান হলো বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাতায়। বাতিলের তালিকায়। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে! আইনস্টাইন মনে মনে দুঃখ পেলেও খুশি হলেন অন্য বিজ্ঞানীরা। কুচ্ছিত হাঁসের ছানাকে কে আর পছন্দ করে! কাজেই এরপরের বাক্যটা হওয়া উচিত ছিল—‘অতঃপর, তাহারা সুখেশান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল!’

কিন্তু না, সেই সুখও তাঁদের কপালে বেশি দিন সইল না। কারণ দীর্ঘ প্রায় ৬৭ বছর পর পুনরুজ্জীবন পেল এই ধ্রুবক। সেই ফিরে আসাটাও যেনতেন সাধারণ ব্যাপার নয়, বলা যায়, মহাসমারোহে ফিরে আসা। তা–ও নতুন এক রহস্যের কাঁধে চড়ে। সেই রহস্যের পিছে দিন-রাত ছুটেও কোনো তল খুঁজে পেলেন না বিজ্ঞানীরা। এমনকি এখনো তা রহস্যের চাদরেই ঢাকা। বিজ্ঞানীদের কাছে যা এক দুঃস্বপ্নের মতো। কিন্তু কী সেই রহস্য? কেনই-বা বিজ্ঞানীদের কাছে তা দুঃস্বপ্নের মতো?

রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার আবিষ্কারের জন্য ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পায় সল পার্লমুটারের সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্ট এবং অ্যাডাম রিস ও ব্রায়ান পল শ্মিটের হাই-জেড টিম।

২.

১৯৯৮ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই দল বিজ্ঞানী একটা নতুন কিছু করার কথা ভাবলেন। শুরুতে কেউ কারও খবর রাখেননি। কিন্তু পরে দেখা গেল, দুই দলই বেছে নিয়েছে একই গবেষণার বিষয়। এদের একদল পদার্থবিজ্ঞানী। এর নেতৃত্বে ছিলেন সল পার্লমুটার। সবার কাছে দলটি পরিচিতি সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্ট নামে। আরেক দল জ্যোতির্বিজ্ঞানী। এর নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডাম রিস এবং ব্রায়ান পল শ্মিট। এরা পরিচিত হাই-জেড সুপারনোভা সার্চ টিম, সংক্ষেপে হাই-জেড টিম নামে। শুরুতে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করলেও অচিরেই একদল আরেক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেল। দুই দলের মধ্যে শুরু হলো তীব্র প্রতিযোগিতা। বেশ রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার শুরু হলো বিজ্ঞান জগতে।

মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবল প্রমাণ করেন, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে

সে সময় মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। এ সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমাণ তখন বিজ্ঞানীদের ঝুলিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মনে তখন উদয় হয়েছে নতুন এক জিজ্ঞাসা। সেটি হলো: মহাবিশ্ব শেষ পরিণতি কী? মহাবিশ্ব কি চিরকাল এভাবেই প্রসারিত হতে থাকবে, নাকি একটা বিশেষ পর্যায়ে তা উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করবে? মানে সংকুচিত হতে শুরু করবে।

হিসাব কষে দেখা গেল, মহাবিশ্বে যদি পর্যাপ্ত শক্তি ঘনত্ব থাকে, তাহলে এর প্রসারণ একসময় থেমে যাবে। তারপর চুপসে যেতে শুরু করবে মহাবিশ্ব। কিংবা শক্তি ঘনত্ব যদি কম থাকে, তাহলে এর প্রসারণ কখনো থামবে না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রসারণকে কমিয়ে দিতে পারবে মহাকর্ষ। কারণ, মহাকর্ষ সবকিছুকেই টেনে একত্র করার চেষ্টা করবে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটবে?—সে উত্তর পেতে বিজ্ঞানীদের অবশ্যই জানতে হবে, মহাবিশ্ব আসলে কত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে।

সেটা জানার একটা উপায় হলো গ্যালাক্সি বা ছায়াপথগুলো কী হারে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তা হিসাব করা। সেটা করার উপায় হলো গ্যালাক্সিদের ডপলার ইফেক্ট মাপা। এই পদ্ধতিতেই রাস্তায় গাড়ির গতি মাপে পুলিশ। এটা মাপা হয় শব্দের বিচ্যুতি মেপে। তবে আলোরও ডপলার ইফেক্ট আছে। একই উপায়ে যে গ্যালাক্সি যত দ্রুত সরে যাবে, তার আলোয় তত বেশি লোহিত বিচ্যুতি পাওয়া যাবে। মানে বর্ণালি রেখায় সব রঙের আলো লাল প্রান্তের দিকে সরে যাবে। গ্যালাক্সি থেকে আসা আলো তত বেশি লাল হতে থাকবে। এককালে এডুইন হাবলও এই পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রসারণশীল মহাবিশ্বের প্রমাণ দাখিল করেছিলেন।

কিন্তু মহাবিশ্বের কোনো বস্তু বা গ্যালাক্সি আমাদের কাছ থেকে দূরে রয়েছে, তা বোঝা যায় কীভাবে? ধরা যাক, মহাকাশে একটা বস্তু হয়তো আমাদের খুব কাছেই, কিন্তু তার আলো ম্লান। অন্যদিকে অনেক দূরে থাকা কোনো বস্তু যদি পর্যাপ্ত উজ্জ্বল হয়, তাহলে কাছের সেই ম্লান বস্তুর মতোই মনে হবে। অর্থাৎ আমাদের মনে হবে, দুটি বস্তুর দূরত্ব একই। তাহলে এর সমাধান কী?

১৯৩১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে পাশাপাশি দাঁড়িছে আইনস্টাইন এবং হাবল

এই বিভ্রান্তি থেকে জ্যোতির্বিদদের উদ্ধার করেছিলেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ হ্যানরিয়েটা লেভিট। সে জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন খুব বুদ্ধিদীপ্ত পদ্ধতি। এর সমাধান দিতে পারে সেফিড ভ্যারিয়েবল স্টার বা শেফালি বিষম তারা। সেফিড স্টারের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা বা দীপ্তি বিজ্ঞানীদের জানা। এ ধরনের তারাগুলোর উজ্জ্বলতা সব সময় এক রকমই হয়। কাজেই কোনো গ্যালাক্সিতে একটা সেফিড স্টার খুঁজে পাওয়া গেলে তাকে অন্য কোনো নক্ষত্র বা অন্য কোনো সেফিড স্টারের দীপ্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়। দূরত্ব যত বাড়ে, তার দীপ্তি তত কম হবে। বা আমাদের কাছে তত বেশি ম্লান দেখাবে। এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কটা বর্গীয় হারের। কোনো বস্তু যত দূরে, সেটি ম্লান হবে দূরত্বের বর্গ হিসেবে। যেমন ধরা যাক, দুটি সেফিডের একটির তুলনায় আরেকটি যদি ৯ ভাগ ম্লান হয়, তাহলে তুলনামূলক ম্লানটি অন্যটির চেয়ে তিন গুণ বেশি দূরত্বে অবস্থিত। সে কারণে সেফিড স্টারকে বলে হয় মহাকাশের আদর্শ বাতি বা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল। মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্যালাক্সির কোনটা আমাদের কাছ থেকে কত দূরে রয়েছে, সেটা মাপতে হাবল ব্যবহার করেছিলেন এই পদ্ধতি।

এককালে মহাকাশে কোনো বস্তুর দূরত্ব মাপার জন্য এটিই ছিল আদর্শ পদ্ধতি। কিন্তু মহাবিশ্বের বহু বহু দূরের কোনো শেফালি তারা খুব ম্লান দেখা যায়। তাতে অনেক বেশি দূরত্বে এ তারাকে আদর্শ বাতি হিসেবে ব্যবহার করা বিজ্ঞানীদের জন্য একসময় দুরূহ হয়ে উঠল। কাজেই নতুন আদর্শ বাতি আবিষ্কার হয়ে উঠেছিল সময়ের দাবি। বিজ্ঞানের মজা হলো কোনো সমস্যার পেছনে লেগে থাকলে একসময় না একসময় তার সমাধান খুঁজে পান বিজ্ঞানীর। নতুন আদর্শ বাতির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। অচিরেই বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন সুপারনোভা হতে পারে মহাবিশ্বের বহু বহু দূরের বস্তুর জন্য আদর্শ বাতি। সেটা কী রকম?

তার আগে জানতে হবে সুপারনোভা কী? কেন? এবং কীভাবে? অতি ভারী কোনো নক্ষত্রের মৃত্যু ঘনিয়ে এলে একটা চরম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন নক্ষত্রটির সবটুকু জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে। জ্বালানি মানে, নক্ষত্রের প্রাণভোমরা হাইড্রোজেন পরমাণু। নক্ষত্রের বুকে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেনকে প্রবলভাবে পরস্পরের কাছে টেনে আনে মহাকর্ষ বল। তৈরি হয় একটা কেন্দ্রমুখী বল। এতে হাইড্রোজন পরমাণুদের চিড়েচ্যাপ্টা দশা শুরু হয়। এ পর্যায়ে দুটি হাইড্রোজেন পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লেগে যায়। তৈরি হয় হিলিয়াম পরমাণু। এ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় বিপুল শক্তি—অর্থাৎ প্রচণ্ড তাপ ও আলো। মুহুর্মুহু হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা এটা। যেমন আমাদের সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় ১৫ মিলিয়ন কেলভিন। সেখানে সেকেন্ডে এক বিলিয়নের বেশি হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের সমতুল্য হারে শক্তি উৎপাদিত হয়। অতি ভারী নক্ষত্রের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ আরও অনেক অনেক বেশি।

যা–ই হোক, এই প্রচণ্ড তাপ নক্ষত্রের বুকে থাকা সবকিছুকে ঠেলে দেয় বাইরের দিকে। মানে মহাকর্ষের ঠিক বিপরীতে দিকে। নক্ষত্রের বুকে এই দুই বিপরীত বলের ঠেলাঠেলি সব সময়ই চলছে। এই ঠেলাঠেলির মধ্যে ভারসাম্য এলেই নক্ষত্রটা টিকে থাকে দীর্ঘদিন। আমাদের সূর্যও ঠিক এভাবেই টিকে আছে প্রায় ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি বছর, টিকে থাকবে আরও প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর। কিন্তু নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে কী হয়?

মহাবিশ্বে ডার্ক এনার্জির যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, বিভিন্ন গবেষক দলের হিসাবে তাতে কিছুটা তফাত আছে। গড় হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ৬৮ ভাগ। আর মহাবিশ্বের বাকি অংশগুলোর মধ্যে ২৭ ভাগ ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তু এবং মাত্র ৫ ভাগ দিয়ে আমাদের চেনা পরিচিত বস্তুজগৎ—মানে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, ধূমকেতু, গ্রহাণু, আমাদের সৌরজগৎ, পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ এবং জীবজগৎ গঠিত।

: পৃথিবী থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে ক্র্যাব নেবুলা। ১০৫৪ সালে এক সুপারনোভা বিস্ফোরণে সৃষ্ট হয় এই নেবুলা।

তখন শুরু হয় হিলিয়াম চক্র। মানে হিলিয়াম পরমাণুরা আগের মতো চিড়েচ্যাপ্টা হতে থাকে। তৈরি হয় আরও ভারী মৌল। একসময় হিলিয়ামও ফুরিয়ে যায়। তখন শুরু হয় কার্বন চক্র। কিন্তু এভাবে ক্রমান্বয়ে অক্সিজেন, নিয়ন, সিলিকন চক্র চলতে চলতে শুরু হয় লৌহ চক্র। এই পর্যায়ে এসে মহাকর্ষের কারণে সৃষ্ট শক্তিশালী চাপের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের চাপ আর ধরে রাখতে পারে না। তখন চুপসে যেতে থাকে নক্ষত্রের কেন্দ্র। চুপসে যেতে যেতে একপর্যায়ে বাইরের দিকে আকস্মিকভাবে ঘটে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। তাতে নক্ষত্রটির সবকিছু টুকরা টুকরা হয়ে মহাকাশের চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে। এই সুপারনোভা বিস্ফোরণ চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। একে বলা চলে মহাজাগতিক আতশবাজি।

এই দীপ্তির পরিমাণ আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন গুণ বেশি। আরও সহজ করে বলতে গেলে একটা সুপারনোভা মাত্র কয়েক মিনিটে যে পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে, সমপরিমাণ শক্তি বিকিরণ করতে আমাদের সূর্যের লাগবে গোটা জীবন। মানে ১০ বিলিয়ন বছর। কাজেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাকাশে বা কোনো গ্যালাক্সিতে সুপারনোভা শনাক্ত করা মোটামুটি সহজ। অনেক সময় খালি চোখেই আকাশে তা শনাক্ত করা যায়। মধ্যযুগে চীনে এ রকম একটি সুপারনোভা দেখার বিবরণ পাওয়া যায়।

প্রচণ্ড অগ্নিময় ও ঘটনাবহুল সুপারনোভা নিয়ে অনেক দিন ধরেই পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। তাই এদের আচার-আচরণ তাদের বেশ ভালোই জানা। এই বিস্ফোরণ প্রায় একইভাবে ঘটে এবং বিকিরণ বা আলোও নিঃসরণও করে প্রায় একই পরিমাণ। কাজেই এদের আলোকে মহাবিশ্বের কোনো বস্তুর আপেক্ষিক দূরত্ব মাপার জন্য রেফারেন্স বা মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাই সুপারনোভাকে একসময় আদর্শ বাতি বা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডল হিসেবে বেছে নেন বিজ্ঞানীরা। আবার এর লোহিত বিচ্যুতি মেপে নির্ণয় করা যায়, এরা কত দ্রুত আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।সাধারণত দুই ধরনের সুপারনোভার কথা বলেন জ্যোতির্বিদেরা। একটা টাইপ ওয়ান এবং আরেকটি টাইপ টু। দুই ধরনের মধ্যে আরও উপধরনও আছে। জটিলতা এড়াতে এখানে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলছি না। এর মধ্যে টাইপ ওয়ানের এ ধরনটিকে আদর্শ বাতি হিসেবে ব্যবহার করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক দল। এবারও দেখা গেল, মহাবিশ্বের সবকিছু ছুটছে দিগ্‌বিদিক। মানে প্রসারিত হচ্ছে।

কাজেই ১৯২০-এর দশকে মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ে হাবলের সিদ্ধান্তে কোনো ভুল নেই। কিন্তু নতুন আরেকটি ফলাফল দেখে দুই দল বিজ্ঞানীর চোখ কপালে উঠল। সেটা কী?এ গবেষণায় কাছে ও দূরের সুপারনোভাগুলোর লোহিত বিচ্যুতি ও উজ্জ্বলতা মাপলেন পার্লমুটার এবং রিসের দল। এর মাধ্যমে মহাবিশ্ব বর্তমানে কত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, তা মাপা গেল। বহুদূরের সুপারনোভাদের লোহিত বিচ্যুতি মেপে পাওয়া গেল মহাবিশ্ব অতীতে কী হারে বা কত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল, তার পরিমাণ। এরপর এই দুই ফলাফল তুলনা করে দেখা হল। বিস্ময়কর ব্যাপার, মহাবিশ্ব অতীতের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশি দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। এর সরল অর্থ, মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিতই হচ্ছে না, কোনো একভাবে এর গতিও বেড়ে যাচ্ছে।

মহাবিশ্বে ডার্ক এনার্জি, ডার্ক ম্যাটার এবং আমাদের পরিচিত বস্তুজগতের অনুপাত

কোনো বস্তু বা ভর যদি বেগ পরিবর্তন করে, তাহলে বিজ্ঞানীরা বলেন, তার পেছনে কোনো বল বা ফোর্স কাজ করছে। আর কোনো কিছুর বল প্রয়োগের ক্ষমতা থাকা মানে, তার শক্তি বা এনার্জি আছে। মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের পর থেকে মহাবিশ্বের শক্তির পরিমাণ বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে বের করেছেন, এই শক্তি ঘনত্বে মহাবিশ্বের কী হারে প্রসারিত হওয়া উচিত। কাজেই মহাবিশ্বের সবকিছু এই অনুমিত হারের চেয়ে বেশি জোরে ছোটার অর্থ হলো তার পেছনে অতি অবশ্যই কোনো শক্তি দায়ী। সেই শক্তির নাম দেওয়া হলো ডার্ক এনার্জি। বাংলায় যাকে বলা হয় গুপ্তশক্তি। তমোশক্তিও বলেন কেউ কেউ। অনেকে হয়তো ভাববেন, শক্তিটার রং কালো বলে এমন নাম। আসলে তা নয়। শক্তিটা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি অন্ধকারে আছেন, এ সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। তাই অজানা-অচেনা শক্তির এই নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2-এর সঙ্গে মোটামুটি সবাই পরিচিত। এই সমীকরণ অনুসারে, শক্তি ও ভর পরস্পর রূপান্তরযোগ্য। অর্থাৎ শক্তিকে ভরে এবং ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। সেই অনুযায়ী ডার্ক এনার্জির ভর কতটা হতে পারে, সেই হিসেব কষা হয়েছে। এভাবে মহাবিশ্বে ডার্ক এনার্জির যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, বিভিন্ন গবেষক দলের হিসাবে তাতে কিছুটা তফাত আছে। গড় হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ৬৮ ভাগ। আর মহাবিশ্বের বাকি অংশগুলোর মধ্যে ২৭ ভাগ ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তু এবং মাত্র ৫ ভাগ দিয়ে আমাদের চেনা পরিচিত বস্তুজগৎ—মানে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, ধূমকেতু, গ্রহাণু, আমাদের সৌরজগৎ, পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ এবং জীবজগৎ গঠিত।

রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার আবিষ্কারের জন্য ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পায় সল পার্লমুটারের সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্ট এবং অ্যাডাম রিস ও ব্রায়ান পল শ্মিটের হাই-জেড টিম।

অনেকেই প্রশ্ন করবেন এ লেখার শুরুতে যে আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধ্রুবকের কথা বললাম, তার সঙ্গে ডার্ক এনার্জির সম্পর্ক কী? এর উত্তরে বলতে হয় অনেকে মনে করেন, রহস্যময় ডাক এনার্জিই আসলে আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধ্রুবক। ডার্ক এনার্জিও কাজ করে প্রতিমহাকর্ষের মতো। অনেকের হিসাবে, দুটোর মানও সমান। এভাবেই ডার্ক এনার্জির কাঁধে চেপে মহাসমারোহে ফিরে এসেছে মহাজাগতিক ধ্রুবক। কিন্তু সেটাই এখন বিজ্ঞানীদের কাছে দুঃস্বপ্নের নাম। ভাবছেন, কেন?

কারণ, বিজ্ঞানীরা হাজারো চেষ্টা করেও এখনো বুঝে উঠতে পারেননি এই ডার্ক ম্যাটার আসলে কী। অনেকে অনুমান করার চেষ্টা করেছেন, প্রকৃতির চারটি মৌলিক বল—মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লিয়ার বল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের মতো এটাও নতুন কোনো মৌলিক বল। কিন্তু সেই অনুমানও শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। আবার অনেকের ধারণা, সেটা আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের ফলাফল হতে পারে। কিন্তু ওই অনুমান পর্যন্তই, কোনো ধারণা কাজে লাগিয়েই শেষ পর্যন্ত এর রহস্য ভেদ করা যায়নি। তাই মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর মধ্যে অন্যতম রহস্য হচ্ছে ডার্ক এনার্জি। 



Share On:

0 Comments

No Comment Yet

Leave A Reply

Nagorik Alo is committed to publish an authentic, Informative, Investigate and fearless journalism with country’s people. A highly qualified and well knowledged young team of journalists always fetch real news of the incidents or contemporary events. Providing correct news to the country's people is one kinds of community service, Keeping this in mind, it always publish real news of events. Likewise, Nagorik Alo also promised to serve the Bangladeshi people who reside in out of the country.

সম্পাদক : মোঃ ইলিয়াস হোসেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : আরিফুর রহমান info@nagorikalo.com যোগাযোগ : 30/A, সাত্তার সেন্টার ( হোটেল ভিক্টরি) লেভেল 9, নয়া পল্টন, ঢাকা--১০০০ +8801753634332

© ২০২৩ nagorikalo.com