সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেদার আসছে ভারতীয় চিনি। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব চিনি দেশে ঢোকার পর খুচরা বাজারে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হওয়ায় চিনি চোরাচালানে যুক্ত হয়ে পড়েছেন ছাত্রলীগের নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ-বিজিবিকে ‘ম্যানেজ’ করে চিনি চোরাচালানে সহায়তা করছেন সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। চোরাকারবারিদের সঙ্গে বনিবনা না হলে চালানের গাড়ি ছিনতাইও করছেন তাঁরা। চোরাচালানে নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ছাত্রলীগ। তবে সম্প্রতি চিনি ছিনতাইয়ের ঘটনায় দুই নেতার ফোনালাপ ফাঁস হলে সমালোচনার মুখে দুটি শাখার কমিটি বাতিল করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
শুধু ছাত্রলীগ নয়, ক্ষমতাসীন দলের আরও দুই সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের নামও আসছে চিনি চোরাচালানে। এসব নজরে আসায় দলের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য হাইকমান্ডকে অবগত করেছেন খোদ আওয়ামী লীগের নেতারা। অসহায় হয়ে চোরাচালান বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপও চান তাঁরা।
চিনি চোরাচালানে সম্পৃক্ততা নিয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলেছিলেন সংগঠনটির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও বর্তমানে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) প্রবাল চৌধুরী পূজন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ২০২৩ সালের আগস্টে তাঁর ওপর হামলা করেছিলেন সিলেট ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এ ঘটনায় প্রবাল চৌধুরী সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক, সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শাখার সভাপতি, জকিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের ৫৫ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় সব আসামি চিনি চোরাচালানে জড়িত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে ঘটনাটি তদন্তে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এর সদস্যরা তদন্তের কাজে সিলেটে আসেননি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি বরিকুল ইসলাম বাধন বলেন, ‘আমরা ফিজিক্যালি যেতে পারিনি। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাসহ যেসব সোর্স রয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক তো প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি। আর বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সমাধানও করা হয়।’ তবে এপিপি প্রবাল চৌধুরী পূজন জানান, ‘মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে। ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’
চোরাচালানে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। ৬ জুন সিলেটে প্রথম ও বড় চালান ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি জব্দ করে নগর পুলিশ। এ ঘটনায় নাম উঠে আসে যুবলীগ নেতাদের। একই দিন শায়েস্তাগঞ্জে আরও পাঁচ ট্রাক চিনি জব্দ করা হয়। এরপর ছোট-বড় অভিযানে একের পর এক চোরাই চিনি ধরা পড়া শুরু করে। পরদিন সুনামগঞ্জ থেকে যাওয়া চিনিবোঝাই একটি ট্রাক গাজীপুরের কালীগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকালে র্যাব সদস্যসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসব ঘটনায় পৃথক মামলা করা হয়।
৮ জুন বিয়ানীবাজারে সরকারি নিলামে কেনা ‘২৪ লাখ টাকার চিনি’ গুদামে নিয়ে আসার পথে লুট করে নিয়ে যান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাসহ ১১ জনের নামে মামলা করা হয়। এ নিয়ে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক-সহসভাপতির ফোনালাপ ভাইরাল হলে সমালোচনার মুখে বিয়ানীবাজার উপজেলা ও পৌর শাখা কমিটি বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পুলিশ ছিনতাই হওয়া ৮০ বস্তা চিনি উদ্ধারের পাশাপাশি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, পৌর সভাপতিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর ১৩ জুন রাতে চোরাই চিনি ছিনতাইকালে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিন জকিগঞ্জের কালীগঞ্জ এলাকায় ভারতীয় চোরাই চিনি ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান আহমদসহ ৯ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। পরে বিষয়টি নিয়ে খবর প্রকাশিত হলে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে তড়িঘড়ি বিষয়টির সমাধান করা হয়।
চিনি চোরাচালানের অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের নামে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে মামলা করেছিলেন। ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মী এসবের সঙ্গে জড়িত নন। এটা প্রশাসনের কাজ, তারা অবৈধ চিনি ঢুকতে দেয় কেন?’ মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমদ বলেন, ‘ঢালাওভাবে কোনো অভিযোগ করলে আমরা মানব না। কারও সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য-প্রমাণ পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ একই বক্তব্য সুনামগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান রিপনেরও।
যেভাবে দেশে ঢোকে ভারতীয় চিনি
সিলেট ও সুনামগঞ্জ সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই জেলার শতাধিক স্পট দিয়ে অবৈধভাবে ঢোকে ভারতীয় চিনি। ওপার-এপারের চোরাকারবারিরা সীমান্তের কাঁটাতার অতিক্রম করে স্থানীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে গাড়ি বা নৌকা পর্যন্ত নিয়ে আসে চোরাই চিনি। এ জন্য বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা দেওয়া হয় শ্রমিকদের। এরপর সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের হরিপুর বাজার হয়ে বাইপাস-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায় এই চিনি। অন্যদিকে সুনামগঞ্জ শহরের আব্দুজ জহুর সেতু হয়ে রানীগঞ্জ সড়ক এবং গোবিন্দগঞ্জ হয়ে তেমুখী বাইপাস দিয়েও পরিবহন হয় চোরাই চিনি। ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা এসব চিনি নিজেদের জিম্মায় এলাকা পার করিয়ে দেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা পান তাঁরা। ব্যতিক্রম ঘটলে রাস্তা থেকে চিনিবোঝাই ট্রাক ছিনতাই করে নগরের কালীঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেন।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘বিষয়গুলো সবাই জানে, শুধু পেপার-পত্রিকায় আসছে না। যাঁরা মদদ দিচ্ছেন, তাঁরা দল ও সমাজের ক্ষতি করছেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এসব কর্মকাণ্ডে সমাজ-রাজনৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে।’
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘এখন সিলেটে বন্যা চলছে, আপাতত সব নেতা-কর্মীকে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখব।’
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply