কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় যেতে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। ২০২২ সালে এক অফিস আদেশে এই খরচ নির্ধারণ করেছিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এই আদেশ মানছে না রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। দেশটিতে গমনেচ্ছুক একেকজন কর্মীর কাছ থেকে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বেশি আদায় করছে তারা। এই প্রক্রিয়ায় গত দুই বছরে মালয়েশিয়ায় যাওয়া ৪ লাখ কর্মীর কাছ থেকে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত একটি সিন্ডিকেট।এ নিয়ে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এরই মধ্যে অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারের চুক্তির আওতায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০টি নির্ধারিত রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠাত। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে নতুন একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে দুই দেশ। সেই সমঝোতায় রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা ১০টি থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা হয়। তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি বিদেশগামী কর্মীদের। ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেট ভেঙে ১০০ এজেন্সিকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও সেখানেও তৈরি হয় নতুন সিন্ডিকেট। ২০-২৫টি এজেন্সির এই সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করছে মালয়েশিয়ার কর্মী পাঠানোর কাজটি।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বিনিময় ইন্টারন্যাশনাল। রাজধানীর শান্তিনগরে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক এম এ সোবহান ভূঁইয়া, যিনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যানও। শুধু কর্মী পাঠানো নয়, বিদেশগামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আল গোফিলি মেডিকেল সেন্টার নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাঁর। বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে যাঁরা মালয়েশিয়ায় যান, তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা গোফিলি মেডিকেল সেন্টারেই করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী বিদেশগামী কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ৭ হাজার টাকায় করার কথা থাকলেও বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের মেডিকেল সেন্টারটি ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ ব্যক্তি এই মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেক ব্যক্তির একাধিকবারও পরীক্ষা করানো হয়।
বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের অনিয়ম খুঁজতে গিয়ে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানিকারক এজেন্সি সিন্ডিকেটের মূল নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য উদ্ঘাটন করেছে দুদক। মূলত পুরো শ্রমবাজারের সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি এজেন্সি। এই রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক রুহুল আমিন স্বপন। বিনিময়ের মতো ক্যাথারসিসও নিজস্ব মেডিকেল সেন্টার দিয়ে বিদেশগামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ করছে, যেটির নাম মীম মেডিকেল সেন্টার।
বিদেশগামী কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ নিয়ে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিন স্বপনের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর ফোনে কল করলে রিসিভ করেন মো. সালাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। নিজেকে সহকারী ব্যবস্থাপক পরিচয় দেওয়া মো. সালাউদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘স্যার দেশের বাইরে আছেন। দুদকের অনুসন্ধানের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।’
অন্যদিকে বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার এম এ সোবহান ভূঁইয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আমার কাছে সব মানি রিসিট আছে। কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়নি। আর মেডিকেল ফির টাকাও সরকার-নির্ধারিত ৭ হাজারের অতিরিক্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। একাধিকবার টেস্ট করার অভিযোগও মিথ্যা।’
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সরকার-নির্ধারিত ফি নিচ্ছে বলে দাবি করলেও তাদের এই দাবি ডাহা মিথ্যা বলে জানিয়েছেন কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় অবস্থান করা প্রবাসীদের স্বজনেরা। দেশটিতে কর্মী ভিসা নিয়ে গেছেন—এমন একজন হলেন মো. হেলাল। মালয়েশিয়ায় যেতে হেলালের ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁর শাশুড়ি মোসাম্মত রেহানা। আশুলিয়ার এই বাসিন্দা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি তো এত কিছু জানি না। জামাই প্রথমে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছে। পরে বলছে ৪ লাখ টাকা না দিলে পাসপোর্ট দিবে না। আমি গরিব মানুষ, মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করি। অগত্যা জমি বন্ধক রেখে আরও ৫০ হাজার টাকা জামাইকে তুলে দিই।’
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছেন কুমিল্লার দুলাল হোসেন, ময়মনসিংহের আবু জাফর, মো. মানিকসহ বেশ কয়েকজন প্রবাসীর স্বজন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। এতে তাঁদের একেকজনের ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে।
কর্মী হিসেবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য ঢাকায় বিনিময় ইন্টারন্যাশনালসহ অন্তত ২০টি রিক্রুটিং এজেন্সিতে ঘুরেছেন জয়পুরহাটের জিয়াউল হাসান জিয়া। তিনি জানান, কোনো এজেন্সি ৪ লাখ, আবার কোনো এজেন্সি ৬ লাখ টাকাও চেয়েছে তাঁর কাছে। আজকের পত্রিকাকে জিয়া বলেন, ‘ঢাকায় আল বুখারি নামের একটি প্রতিষ্ঠানে যাই। কিন্তু নির্ধারিত টাকায় না নিয়ে আমাকে ৪ লাখ দিতে বলা হয়েছে। বিনিময় ইন্টারন্যাশনালও ৩ লাখ টাকা চেয়েছে। কিন্তু বিদেশে যেতে পারিনি।’
একই অভিযোগ করেছেন মো. হুমায়ুন নামের আরেক ব্যক্তি। তিনিও বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির অতিরিক্ত অর্থ আদায় দেখে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, কারও কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে এমন অভিযোগ এখনো পাইনি। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কড়া নজরদারির মধ্যে আছে। কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থার মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণিত হলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বাতিল করতে পারে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী।
দুদকের কাছে আসা অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সংস্থাটির উপপরিচালক মো. আবু সাঈদ। অনুসন্ধান শুরুর পর তথ্য চেয়ে অভিযোগে নাম আসা রিক্রুটিং এজেন্সিকে এরই মধ্যে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। তবে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দুদকের এই অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা।
দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, অনুসন্ধান শুরু হলেই তো কিছু বলা যায় না। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদক আইন অনুসরণে অনুসন্ধান করবেন।
Share On:
17 Comments
spKIHLfxw
November 04, 2024 at 11:46pmspKIHLfxw
November 04, 2024 at 11:46pmMFrkYrAjQUaZ
November 14, 2024 at 5:02amMFrkYrAjQUaZ
November 14, 2024 at 5:03amIGqDelHNDayhV
November 22, 2024 at 4:03pmIGqDelHNDayhV
November 22, 2024 at 4:03pmOQRmjAIUhf
November 25, 2024 at 4:51amhCnWhsNjcEL
November 29, 2024 at 4:27pmhCnWhsNjcEL
November 29, 2024 at 4:27pmvCpMHJDYSwc
December 01, 2024 at 6:53amLeave A Reply