নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের ঘাটতি মোকাবিলায় ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হবে। এর সঙ্গে আগের নতুন-পুরান ঋণ পরিশোধের চাপও যুক্ত হবে এ অর্থবছরে। ফলে সরকারকে বার্ষিক বাজেটের আয়ব্যয়ের খাত নিয়ে যতটা ভাবতে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ভাবনা ঢুকিয়েছে ঋণ পরিশোধের অতিরিক্ত চাপ। এমনিতেই সরকারের চলতি হিসাবে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। এমন এক কঠিন বাস্তবতায় নানামুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঋণ ও ঘাটতি নির্ভর বাজেট আজ সংসদে ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। থাকবে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার। টানা চতুর্থ মেয়াদে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের এটি প্রথম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ২১তম বাজেট। এদিকে বর্তমান আর্থসামাজিক বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেটটা দিতে হোঁচটও খেতে হচ্ছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গিয়ে বাজেটের আকারই কমিয়ে এনেছেন তিনি। আজ বিকাল ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী। আর্থিক সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে বার্ষিক বাজেট কমিয়ে আনা হলো ৫ শতাংশের বেশি। একই সঙ্গে উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অধিক গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। ফলে এবারের বাজেটে ঘাটতিও থাকছে বিশাল আকারের।
এমন এক বৈরী সময়ে নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী, যখন মূল্যস্ফীতির চাপ কোনোভাবেই কমছে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতিও অশান্ত। টানা ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ ঊর্ধ্বমুখী। এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাম। পানির দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে ওয়াসা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। জীবনযাত্রার ব্যয় সামলাতে মানুষ দিশাহারা। ডলারের বাজারেও নেই কোনো সুখবর। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তো কমছেই। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের চাকা বলতে গেলে আটকেই রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ মুহূর্তে দেশের অভ্যন্তরের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ব্যবসাবান্ধব নয়। বিশ্ব প্রেক্ষাপটও নতুন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে; যা বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থির থাকতে দিচ্ছে না। তবে সব অস্বস্তির মধ্যেও স্বস্তির খবর হলো, আমাদের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী ভারতে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। কেননা ভারতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘এবারের বাজেটে আইএমএফের প্রভাব অনেক বেশি থাকছে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমার পাশাপাশি জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও এবারও করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই ৩ লাখ টাকাই থাকছে।’ আজ সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতিই থাকবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা; যা জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এ বিশাল পরিমাণ ঘাটতি পূরণে কয়েকটি খাতকে উৎস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্যাংকিং খাত।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি : আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫। যদিও আর্থিক সংকটের কারণে পরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। এদিকে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বড়জোর ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রায় কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। বাজেট উপস্থাপনের পরদিন অর্থাৎ আগামীকাল শুক্রবার বিকাল ৩টায় বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে।
বাজেট অধিবেশন শুরু : আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদের প্রথম বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল বিকাল ৫টায় জাতীয় সংসদের বৈঠক শুরু হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশন এটি। আজ সংসদে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে।
অধিবেশন শুরুর পর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সভাপতিমন্ডলীর সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। মনোনীত পাঁচ সদস্য হলেন ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন, শাহরিয়ার আলম, সালমা ইসলাম ও ফরিদা ইয়াসমিন। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে নামের অগ্রবর্তিতা অনুযায়ী সভাপতিমন্ডলীর সদস্যরা অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন। অধিবেশনের শুরুতে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সবাইকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম বাজেট অধিবেশনে স্বাগত জানান। সংসদ অধিবেশন শুরুর আগে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে চলতি অধিবেশনের মেয়াদ ও বাজেটের ওপর আলোচনাসহ সার্বিক কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির সভাপতি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে কমিটির সদস্য এবং সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ বিকাল ৩টায় অধিবেশন শুরু হবে। শুক্রবার, শনিবার ও সরকারি ছুটির দিন অধিবেশন হবে না। তবে ২২ ও ২৯ জুন শনিবার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত অধিবেশন চলবে। ১৩ জুন অধিবেশন মুলতবি হয়ে ১৯ জুন পুনরায় শুরু হবে। সংসদের কার্যাবলির পরিমাণ বিবেচনায় স্পিকার অধিবেশনের স্থায়িত্বকাল নির্ধারণ করবেন। প্রয়োজনে অধিবেশনের সময় ও কার্যদিবস সম্পর্কিত যে কোনো পরিবর্তনের ক্ষমতা স্পিকারকে প্রদান করা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন কমিটির সদস্য বিরোধী দলের নেতা জি এম কাদের, আমির হোসেন আমু, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওবায়দুল কাদের, রাশেদ খান মেনন, আনিসুল হক, বিরোধী দলের উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ডেপুটি স্পিকার মো. শামসুল হক টুকু, ডা. দীপু মনি, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী এবং এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন। সভাপতির অভিপ্রায় অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply