প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রাণিকুলেরও। নষ্ট হচ্ছে মাঠের ফসল। এই পরিস্থিতিতে গাছের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সর্বত্র। অথচ উল্টো পথে হাঁটছে রংপুরের বন বিভাগ। গাছ কাটার উৎসবে মেতেছে তারা। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারাগঞ্জ উপজেলার তিস্তা সেচ ক্যানেলের উন্নয়নকাজের জন্য পাশের সড়কটি ‘ন্যাড়া’ করা হচ্ছে।
এদিকে বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী আয়তনের তুলনায় ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও তারাগঞ্জে রয়েছে ৩ শতাংশের কম। এখানে বনায়নের বড় অংশ তিস্তা সেচ ক্যানেলকেন্দ্রিক। এসব গাছপালা কেটে ফেলা হলে ১ শতাংশের নিচে পৌঁছাবে। সবকিছু জানার পরও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উন্নয়নমূলক কাজের জন্য গাছগুলো কেটে ফেলার দরপত্র দিয়েছে। ইতিমধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ গাছ কাটা হয়েছে।
গত রোববার দুপুরে খরতাপ উপেক্ষা করে তিস্তা সেচ ক্যানেলের ধারে থাকা গাছ কাটতে দেখা গেছে একদল শ্রমিককে। কেটে ফেলা গাছ থেকে কয়েকজন নারী রান্নার খড়ি সংগ্রহ করছেন।
কথা হয় ক্যানেলঘেঁষা দৌলতপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ক্যানেলের ধারে গাছ থাকায় ছেলেমেয়েরা এদিক দিয়ে শান্তিতে স্কুল-কলেজে যায়। কিন্তু এখন খাঁ খাঁ রোদ মাথায় নিয়ে স্কুল-বাড়ি যেতে হবে। আর গাছগুলোর তো বেশি বয়সও হয়নি। এগুলো না কাটলে কী এমন ক্ষতি হতো!’
ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা খলিলুর রহমান বলেন, ‘ছোট-বড় কোনো গাছই রাখা হচ্ছে না। সব কেটে সাবাড় করছে। গাছগাছালি থাকায় ক্যানেলের ধারে বিকেলে অনেকে ঘুরতে আসত। এখন তো আমাদের আশপাশের ছয়-সাত গ্রামের মানুষের তারাগঞ্জ যাতায়াতে কষ্ট হবে। গাছগুলো কাটা বন বিভাগের হঠকারী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই না।’
এ বিষয়ে পরিবেশবাদী ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘এত গাছ একসঙ্গে কাটা অন্যায়। যে উদ্দেশ্যে গাছগুলো কাটছে, সেটি ভালো নয়। ক্যানেল সংস্কারের নামে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার যে প্রজেক্ট নিয়েছে, তার কোনো দরকার নেই। অপ্রয়োজনে অর্থের অপচয়। এ জন্য আবার গাছগুলো কাটতে হয়েছে। গাছগুলো না কাটলে অর্থের অপচয় করতে পারত না।’
উপকারভোগী, ঠিকাদার ও বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার কেল্লাবাড়ি থেকে তারাগঞ্জের মিনিটের স মিল পর্যন্ত দুই পাশে পাঁচ কিলোমিটার অংশের প্রায় ২ হাজার গাছ বিক্রি করা হয়। ২২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৫০ টাকায় দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এসব গাছ দেওয়া হয়। গাছ বিক্রির ৮০ শতাংশ টাকা উপকারভোগী ও ২০ শতাংশ টাকা বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ পাবে।
নিজের হাতে লাগানো গাছের ছায়ায় শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে উপকারভোগী আনিছা বেগম ও রশিদা বেগম আজকের পত্রিকাকে জানান, তাঁরা ৫৭ জন গাছগুলোকে সন্তানের মতো পরিচর্যা করেছেন। গাছগুলো কাটা হচ্ছে, এ জন্য দেখতে এসেছেন। তবে এ গাছ বিক্রির টাকা পাবেন কি না, তা তাঁরা জানেন না।
গাছ কাটা ঠিকাদার দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার কুচদহ এলাকার মাসুদ রানা বলেন, ‘বন বিভাগ দরপত্র দিয়েছি, আমরা গাছ কিনেছি। সময় হয়েছে, তাই গাছ কাটছি। তবে গাছ না থাকলে এই ক্যানেলের পাশের সড়ক দিয়ে সত্যি যাতায়াতে খুব কষ্ট হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল রানা বলেন, ‘গাছগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বন বিভাগের। তবে তাপপ্রবাহের সময় গাছগুলো কাটা ঠিক হয়নি। বাকি গাছগুলো যাতে তাপপ্রবাহ পর্যন্ত কাটা না হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জানাব।’
উপজেলা বন কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান রোকন বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকেরা ভেকু দিয়ে মাটি ফেলার সময় গাছগুলো ভেঙে দিচ্ছিল। তাই বিভাগীয় অফিস থেকে দরপত্র আহ্বান করে গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ ক্যানেলের উন্নয়নমূলক কাজ শেষ হলে ফের গাছ লাগানো হবে।’
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply