এক ডলার-সংকটেই যেন দেশের সমগ্র অর্থনীতিতে মন্থর দশা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রিজার্ভ, উৎপাদন, মূল্যস্ফীতি, আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আদায়, সুদের হার এবং কর্মসংস্থানে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ডলার-সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত কোনো নীতিমালাই কাজে আসছে না।
এতে সর্বত্র দেখা দিয়েছে হতাশা। এমন বেসামাল পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়ে ডলারের দাম আটকে রাখার অবস্থান থেকে পিছু হটে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে এক দিনেই ৭ টাকা বাড়িয়েছে; যা আমদানি পণ্য ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ উসকে দিয়েছে। পাশাপাশি হঠাৎ করে বাজারের ওপর সুদের হার ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাকেও ভালো দেখছেন না ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় সামনে বিনিয়োগ ও ব্যবসা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নতুন শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগ কমলে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে ৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। তার আগে ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৪৪ দশমিক ১০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। গত ২০২২-২৩ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল যথাক্রমে ৭৫ দশমিক শূন্য ৬ কোটি ডলার ও ৮৯ দশমিক ১৬ কোটি ডলার।
তথ্য পর্যালোচনায় জানা গেছে, ২০২২ সালে ডলার-সংকট সামলাতে আমদানি পণ্যের ওপর কড়াকড়ি শর্ত আরোপ করে ব্যাংলাদেশ ব্যাংক। গত মার্চে আমদানি ব্যয় ছিল ৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে প্রতি মাসে গড় আমদানি ব্যয় ছিল ৬ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২২ সময়ে প্রতি মাসে ছিল ৭ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ডলারের কোনো উন্নতি হয়নি। তবে পণ্যের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় কড়াকড়ি শর্তের কারণে শুধু চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ সামগ্রিক আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। আমদানি কমায় একই সময়ে উৎপাদন কমেছে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কারখানায় উৎপাদন কমায় চলতি বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। এভাবে আমদানি-রপ্তানি কমার ফলে রাজস্ব আদায় কমেছে, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা কম। একইভাবে আমদানি-রপ্তানি কমার নেতিবাচক প্রভাবে পড়েছে কর্মসংস্থানে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় পরবর্তী তিন মাসে বেকারত্ব বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডলার-সংকট দূরীকরণের প্রধান হাতিয়ার তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। যেটা এখন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বিলম্ব হয়েছে। যার খেসারত দিতে হয়েছে জনগণকে। এত দিন জোর করে ডলারের দাম আটকে রাখার খেসারত। তবে হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। তবু সমন্বয় করা দরকার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি মাসে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১১৭ টাকা করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যার প্রভাবে আমদানি পণ্যসহ নানা দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। চলতি বছরের জুলাইতে ডলারের দাম ছিল ১০৭ টাকা ৬৫ পয়সা। আর ২০২২ সালের মে মাসে এই রেট ছিল ৮৯ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ২৮ টাকা। এদিকে চলতি মাসের ২১ মে পর্যন্ত মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। যা চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই ছিল ২৯ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরে রিজার্ভ কমেছে ৬ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। আর এই মোট রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। আর বর্তমানে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়নের নিচে নামার রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ডলারের ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে বিলাসী পণ্য নিয়ন্ত্রণ করা ছিল প্রধান লক্ষ্য। এরই মধ্যে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ ডলার বাজার উসকে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, গত এপ্রিলে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আগের মাসের চেয়ে কিছুটা কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগের মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে।
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply