নিমতলি, চুড়িহাট্টার পর আরও একবার এই শহর সাক্ষী হলো সন্তানহারা বাবা মায়ের আর্তনাদ আর অজস্র মানুষের কান্নার। একটির ক্ষত শুকানোর আগেই আরেকটি অগ্নিদুর্ঘটনা, আগুনে প্রাণহানি যেন প্রায় নিয়মিত ঘটনা। আগুনে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না, বরং দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। দেশে গড়ে দিনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ৭৭টি ঘটে। আর এসব ঘটনায় নিরীহ মানুষের প্রাণহানিতে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলাও হয়। তবে তা থেকে যায় অবহেলায়। বিচারের মুখ দেখেনা কোন ঘটনা, ফলে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা।বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে লাগা রাজধানীর বেইলি রোডের আগুন কেবল ৪৬টি প্রাণই কেড়ে নেয়নি। অসংখ্য মানুষকে করেছে স্বজনহারা। ফায়ার সার্ভিসের ১৩ ইউনিটের চেষ্টায় দুই ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুড়ে গেছে বাণিজ্যিক ভবনটি। ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা।
তবে বেইলি রোডের আগুনে এই মৃত্যুর মিছিল নতুন কিছু নয়। গত এক যুগে ঢাকায় অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে বিস্ফোরণ থেকে আগুনের ঘটনায় নারী এবং শিশুসহ নিহত হয় ১২৪ জন। ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জন, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ৩১ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন, বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৬ জন। এসব ঘটনায় অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হলেও সাক্ষী না আসায় এখনো বিচার শেষ হয়নি।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জন নিহত হন। আরও দুই শতাধিক শ্রমিক আহত ও দগ্ধ হন। পরদিন পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে তাজরীন ফ্যাশনের এমডি দেলোয়ারসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। দুই বছর পর ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ । মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে। মামলার ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১১জন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘মামলাটিতে সাক্ষীই আসে না। ১০৪ চারজন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১১ জন আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন।’
শনিবার (২ মার্চ) রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৫ বছর পূর্ণ হল। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সেখানকার ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে আশপাশে আগুন ছড়িয়ে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৬৭ জন। ঘটনার পরদিন মো. আসিফ নামের এক ব্যক্তি থানায় মামলা করেন। মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলেসহ ৮ জনের বিচার শুরু হয়েছে। তবে বিচার শুরুর এক বছরেও শেষ হয়নি মামলার বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ।
মামলার বাদী বলছেন, বিচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা। কোনো ক্ষতিপূরণও পাননি। অপরদিকে, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সোহেল ও হাসানের আইনজীবীর দাবি, সবকিছু হারিয়ে ঘটনার ভিকটিম হয়েছেন তারা।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৭ নিহত হন। এরপর এ ভবন নির্মাণে নানান অনিয়মের বিষয় বেরিয়ে আসতে থাকে। কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়েরে ওই ভবনের জমির মূল মালিক ছিলেন প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ভবনটি নির্মাণ করে রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেড। সে কারণে সংক্ষেপে ভবনের নাম হয় এফআর টাওয়ার। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেন। ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চার্জশিট দেন। এরপর মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। চলতি বছর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধিকতর তদন্ত শেষে আটজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। এফআর টাওয়ারের নকশা জালিয়াতির অভিযোগে ভবন মালিক ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানসহ চারজনের বিচার চলছে। ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ কামাল হোসেনের আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে।
এ বিষয়ে আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাগুলোর মধ্যে এখনো কোনো মামলার রায় হয়নি। এসব মামলায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে মামলাগুল
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাগুলো সাক্ষীর পর্যায়ে রয়েছে। মামলায় কিছু সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন, আবার কিছু সাক্ষী আসেন না। সাক্ষী না আসায় মামলাগুলো শেষ করা যাচ্ছে না। সাক্ষীদের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সমন পাঠানোর পরও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব মামলায় যারা অপরাধী তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অসাবধানতা বা অবহেলার কারণে বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গাফিলতির কারণে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আবাসিক এলাকার একটি ভবনে অর্ধেক রেস্টুরেন্ট আর অর্ধেক অ্যাপার্টমেন্ট করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। একটা ভবনে হয় পুরোপুরি কমার্শিয়াল হবে, না হয় পুরোপুরি অ্যাপার্টমেন্ট হবে। ভবনের মালিকরা লাভবান হওয়ার জন্য এমন করছেন। এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। প্ল্যান দেওয়ার সময় রাজউকের এসব চিন্তা করা উচিত। যারা এসব ঘটনায় দায়ী তাদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply