ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার তদন্ত যেন নতুন মোড় নিল। তদন্তসংশ্লিষ্টরা শুরু থেকে বলছিলেন, স্বর্ণ চোরাচালান- কেন্দ্রিক বিরোধ ও লেনদেনের জের ধরেই এ হত্যাকাণ্ড। কিন্তু হঠাৎ করে সামনে আসছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা।
আজীম হত্যার ঘটনায় এবার আটক করা হয়েছে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে। রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তাঁকে আটক করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের আরও চার নেতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
এর আগে এমপি আনোয়ারুলকে অপহরণ ও গুমের মামলায় গ্রেপ্তার ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু ডিবির সাত দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
ডিবির একটি সূত্র জানায়, গতকাল বিকেলে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার বাসাসংলগ্ন এলাকা থেকে সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করা হয়। এমপি আনোয়ারুল হত্যার ঘটনায় এর আগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে আটক করা হয়। তাঁকে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর সম্পৃক্ততা মিললে তাঁকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
সূত্রটি আরও জানায়, এমপি আনোয়ারুল হত্যার পর খবর পাওয়া এবং নিজেদের মধ্যে ছবি চালাচালি করা ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত চার নেতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ঘটনা জেনেও কেন তাঁরা গোপন রেখেছিলেন, তাঁরা কীভাবে ছবি পেলেন, হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কি না—এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে পুলিশ। নজরদারিতে থাকা নেতাদের দেশত্যাগে নিষেধ করা হয়েছে। তাঁদের যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হতে পারে।
ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতের কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসে মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে গত ১৩ মে এমপি আনোয়ারুলকে হত্যার পর খুনিরা ছবি পাঠায় ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল ওরফে গ্যাস বাবুর কাছে। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের আরও দুই শীর্ষ নেতার কাছেও সেই ছবি পাঠানো হয়। তাঁদের একজন সাইদুল করিম মিন্টু। অপর শীর্ষ নেতা ছাড়াও ঝিনাইদহ পৌর আওয়ামী লীগের এক নেতা ও জনপ্রতিনিধি, কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা এবং কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নজরদারিতে রয়েছেন। তাঁরা এই হত্যার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগেই জানতেন।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলেন, হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমানের জবানবন্দিতে এবং মোবাইল ফোনে কথোপকথনের সূত্র ধরে ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগের নেতাদের নাম আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আক্তারুজ্জামান শাহীন ঘটনার আগে-পরে যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে ডিবি। তাঁরা যাতে দেশত্যাগ না করতে পারেন, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক রয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পর আসামিরা সেখান থেকে কার কার কাছে ছবি ও ভিডিও শেয়ার করেছেন, তার তদন্ত চলছে। ছবি দিয়ে কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে কি না, কাদের মাধ্যমে আর্থিক লাভবান হয়েছে—সব বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনায় ঝিনাইদহের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
এমপি আনোয়ারুল হত্যা মামলায় জিহাদ হাওলাদার কলকাতায় ও সিয়াম হোসেন নেপালে গ্রেপ্তার হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হেফাজতে থাকা সিয়ামের তথ্যের ভিত্তিতে ভাঙ্গড়ের বাগজোলা খাল থেকে গত রোববার বেশ কয়েকটি হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। শনিবার আক্তারুজ্জামান শাহীনের ব্যবহৃত দুটি গাড়ি গুলশানের বাসা থেকে জব্দ করে ডিবি।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম অপু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এমপি আনার হত্যার সঙ্গে যেই জড়িত থাক, সেটা জনগণের সামনে প্রকাশ হোক, সঠিক বিচার হোক। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে এটা আমার চাওয়া। আওয়ামী লীগের নেতারা জড়িত হয়ে পড়লে আমার কিছু করার নেই।’
ঝিনাইদহ-৪ আসনের টানা তিনবারের এমপি ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজীম ১২ মে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান। পরে তিনি নিখোঁজ হন। একপর্যায়ে খবর পাওয়া যায়, চোরাচালানের ২০০ কোটি টাকার সোনা নিয়ে দ্বন্দ্বে ১৩ মে সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে তাঁকে হত্যার পর মরদেহ টুকরা টুকরা করা হয়। সঞ্জীবা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংক থেকে ২৮ মে মানুষের কয়েক টুকরো মাংস উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী গতকাল কলকাতায় বলেন, সিয়ামের তথ্যের ভিত্তিতে হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলোর ডিএনএ প্রোফাইল করতে আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। এমপির স্বজনদের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে হবে। এখানে হাড়ের ডিএনএ হবে। এরপর এমপির মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনকে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য ডাকা হবে। তবে এ জন্য একটু সময় লাগবে।
অখিলেশ চতুর্বেদী আরও বলেন, হত্যায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি নিউমার্কেট এলাকা থেকে কেনা হয়েছিল। তাঁদের আরেকটি লক্ষ্য সেগুলো উদ্ধার করা। সিয়াম জানিয়েছেন, তাঁরা বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে মরদেহ টুকরা টুকরা করেছেন।
‘এমপি আনার চোরাচালানে যুক্ত ছিলেন না’
রাজধানীর রাজারবাগে গতকাল হাইওয়ে পুলিশের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, এই হত্যার সঙ্গে চোরাচালানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই এবং এমপি নিজে চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।’ তিনি বলেন, ‘এমপি আনার চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা আমরা কখনো বলিনি। আমরা সব সময় বলে আসছি, এমপির ওই এলাকা সন্ত্রাসপূর্ণ একটি এলাকা। সত্যিকারে কী হয়েছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। আমরা তদন্ত করছি, তদন্তের পর আপনাদের সবকিছু জানাব।’
শিলাস্তির জামিন নামঞ্জুর
এমপি আনোয়ারুল হত্যার ঘটনায় ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় তাঁর মেয়ে ডরিনের করা অপহরণ ও গুমের মামলায় কারাগারে থাকা শিলাস্তি রহমানের জামিনের আবেদন গতকাল নামঞ্জুর করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলাম। সোমবার জামিন নামঞ্জুর হয় শিমুল ভুঁইয়া ও তানভীরের। তাঁরা তিনজনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ঝিনাইদহে নিরাপত্তা জোরদার
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, এমপি আনোয়ারুল হত্যার ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে আটকের পর জেলা শহরে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিকেল থেকে শহরের পায়রা চত্বর, পোস্ট অফিস মোড়, মুজিব চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ টহল দিচ্ছে।
জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের ভিড় দেখা গেছে। তবে কেউ মুখ খুলছেন না। শহরের আরাপপুরে ইন্দিরা সড়কে মিন্টুর বাড়িতে ছিল নীরবতা। তিনি জেলা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি। তিনি ১১ বছর ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়রের দায়িত্বও পালন করেন।
ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আজিম উল আহসান জানান, সাইদুল করিম মিন্টুকে আটকের পর জেলা শহরে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের টহলও বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে এমপি হত্যায় জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবিতে বিকেলে কালীগঞ্জ উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply