চলতি বছরের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী হজযাত্রীদের ভিসার আবেদনের সময় শেষ হচ্ছে ২৯ এপ্রিল। অথচ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮০ শতাংশ হজযাত্রীই এখনো ভিসার জন্য আবেদন করেননি। এই সংকটের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি এজেন্সিগুলো একে অপরকে দোষারোপ করছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় অবশ্য হজযাত্রীদের ভিসার জন্য আবেদনের সময় বাড়াতে সৌদি সরকারকে চিঠি দিয়েছে।
জানা গেছে, বেসরকারি এজেন্সির প্রতিনিধি বা মুনাজ্জিমদের ভিসা না পাওয়ায় মক্কা-মদিনায় হজযাত্রীদের জন্য বাড়ি ভাড়া করা হয়নি। পাশাপাশি প্রায় ২৮ হাজার হজযাত্রীর মিনা-মুজদালিফায় ঠাঁই পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়ায় ভিসার আবেদন করা যাচ্ছে না। এর জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়কে দায়ী করছে বেসরকারি এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। সংগঠনটির অভিযোগ, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের বাড়িভাড়া ও মুনাজ্জিমদের ভিসার ব্যাপারে কাঙ্ক্ষিত সহায়তা করছে না মন্ত্রণালয়।
একই অভিযোগ অপারেটিং হজ এজেন্সির মালিকদেরও। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা ২০২৪ সালের হজ ব্যবস্থাপনার সব প্রতিবন্ধকতা দ্রুত নিরসন করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চেয়েছেন।
কিন্তু এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় উল্টো এজেন্সির মালিকদের বিরুদ্ধে হজ-বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, নির্ধারিত সময়ে হজযাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিলেও কিছু এজেন্সি বাড়ি ভাড়া করার ব্যাপারে ইচ্ছাকৃতভাবে গড়িমসি করছে। অল্প টাকায় নিম্নমানের বাড়ি ভাড়া করতেই এমন গড়িমসি করা হচ্ছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে কিছু এজেন্সি। এতে মুজদালিফায় কয়েক হাজার হাজির অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সৌদি আরবে হাজিদের থাকা-খাওয়ায় কোনো সমস্যা হলে দায়ী এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ধর্ম মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ধর্মসচিব মু. আবদুল হামিদ জমাদ্দার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা হজযাত্রীদের জন্য বাড়ি ভাড়া করতে গত বছরের ৩০ জুন এজেন্সিগুলোকে নোটিশ দিয়েছি। তারা গুরুত্ব দেয়নি। সরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রীদের বাড়িভাড়া ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হয়েছে। সময়সীমার মাত্র কয়েক দিন আছে। এ অবস্থায় বাড়ি ভাড়া করতে পারছে না বলে মন্ত্রণালয়কে দায়ী করছে! প্রতিবারই তারা এ কাজগুলো করে মন্ত্রণালয়কে চাপে রাখে। তারা তো নির্ধারিত সময়েই হজযাত্রীদের কাছ থেকে প্যাকেজ মূল্য বুঝে নিয়েছে। তাহলে এত দেরি কেন? আমরা ভিসার সময়সীমা বাড়ানোর জন্য সৌদি সরকারকে চিঠি দিয়েছি।’
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১৬ জুন, ৯ জিলহজ হিজরি ১৪৪৫ সনের পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিবছর হজের এক মাস আগে থেকেই শুরু হয় হজফ্লাইট। তার আগে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে হজযাত্রীদের ভিসা, ফ্লাইট শিডিউলসংক্রান্ত কাজ সারে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও এয়ারলাইনসগুলো। এবার এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি ভিসা কার্যক্রম। হজযাত্রীদের চূড়ান্ত তালিকা না পাওয়ায় ঘোষণা হয়নি ফ্লাইট শিডিউলও। অথচ আগামী ৯ মে থেকে হজফ্লাইট শুরু হওয়ার কথা।
হজ প্যাকেজ ঘোষণার সময়ই বলা হয়েছিল, এ বছর ১ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ভিসার আবেদন করা যাবে। কিন্তু এই সময়ে আবেদন পড়েছে মাত্র ১৭ হাজারের কিছু বেশি। ৮০ শতাংশ হজযাত্রী এখনো ভিসার জন্য আবেদন করেননি। এ ছাড়া আগেই এজেন্সির মালিকদের জানানো হয়েছিল, ‘রিফাত’ নামের কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি না করতে। কিন্তু কিছু এজেন্সি ওই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। তাদের হজযাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। এই কোম্পানির আওতাধীন হাজিদের মুজদালিফায় স্থান পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
হাব অবশ্য এর জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়কে দায়ী করেছে। ১৬ এপ্রিল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেছিলেন, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৭৮ হাজার ৮৯৫ হজযাত্রীর বাসাভাড়ার জন্য কোনো সহায়তা করছে না মন্ত্রণালয়। সৌদি দূতাবাস ভিসা না দেওয়া মুনাজ্জিমরা হজযাত্রীদের বাড়ি ভাড়া করতে সৌদি আরবে যেতে পারছেন না। এ কাজেও সহায়তা করছে না মন্ত্রণালয়।
অপারেটিং এজেন্সির মালিকদের পক্ষে আল-কুতুব হজ ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী হাবিবুল্লাহ মোহাম্মদ কুতুবউদ্দিন গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মক্কা হজ মিশনের কিছু কর্মকর্তার অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে হজ ব্যবস্থাপনায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা এবারের হজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছেন। মুনাজ্জিমদের ভিসা পাওয়া এবং এজেন্সির জমা দেওয়া টাকা আইবিএনে স্থানান্তর করতে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
তবে হাব নেতা ও এজেন্সির মালিকদের এসব অভিযোগ আমলে না নিয়ে উল্টো ধর্ম মন্ত্রণালয় বলছে, হজ এজেন্সির অতি মুনাফার লোভে মুজদালিফায় হজযাত্রীদের রাত কাটানো নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। মুজদালিফার খরচ কমাতে এজেন্সিগুলো কালো তালিকাভুক্ত রিফাত নামক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। এ সংকটের বিষয়ে হাবকে আগে জানানো হলেও তারা কর্ণপাত করেনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসেন তসলিম বলেন, ‘এজেন্সিগুলোর পক্ষ থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় গত মার্চে বাড়িভাড়ার টাকা পাঠালেও ধর্ম মন্ত্রণালয় তা সৌদি আইবিএন অ্যাকাউন্টে পাঠায়নি। ফলে মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া করা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি সমাধানের জন্য মক্কায় বাংলাদেশ হজ মিশনের কাউন্সেলর জহিরুল ইসলামকে তাগিদ দেওয়া হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। এ জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ই দায়ী।’
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply