চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কিসমত জাফরাবাদ মৌজায় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) একটি প্লট প্রকল্পে অর্ধেকেরও কম মাটি ভরাট করে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা বিল তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। জাগৃক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পৃথক তদন্তে এর সত্যতা মেলায় ফেঁসে যাচ্ছেন জাগৃকের চার প্রকৌশলী।
সম্প্রতি দুদক মহাপরিচালকের (তদন্ত-২) কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ প্রকল্পের ঠিকাদারসহ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে তিনটি মামলা করার সুপারিশ করেছেন সংস্থাটির পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ভূঁইয়া।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন জাগৃকের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শামসুল আলম, নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদ, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. অলিউল ইসলাম, উপসহকারী প্রকৌশলী আশ্রাফুজ্জামান ও প্রকল্পের ঠিকাদার মাইনুল কবির।
জাগৃক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কিসমত জাফরাবাদ মৌজায় ১৬ দশমিক ২৮ একর জমির ওপর ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর অনুমোদন করে জাগৃক। ১৬৩টি আবাসিক ও চারটি বাণিজ্যিক প্লটের এই প্রকল্পে শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
২০১৯ সালের ২০ মার্চ প্রকল্পটি বাতিল করে জাগৃক। এরপর প্রকল্পের শেষ হওয়া কাজের যৌথ পরিমাপ করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। জাগৃকের চট্টগ্রাম ডিভিশনের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাঈদ রেজাকে আহ্বায়ক ও সদস্য হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গিয়াসউদ্দিন (বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী), সংশ্লিষ্ট উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ার মো. জহিরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ কমিটি সমাপ্ত কাজ পরিমাপের সময় সংস্থাটির তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ উল্যাহও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে অনিয়মের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও দীর্ঘ সময় প্রভাবশালীরা বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন; কিন্তু শেষরক্ষা হচ্ছে না আর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাগৃকের সদস্য বিদায়ী চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ বন্ধ আছে। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুদক তদন্ত করছে। তাই মন্ত্রণালয় বা আমরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছি না। প্রয়োজনে তাদের (দুদক) কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য নেওয়া হবে।’
দুদকের আগেই জাগৃক নিজেই প্রকল্পটিতে অনিয়মের ঘটনা তদন্ত করে। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মিরসরাইয়ের এ প্রকল্পের মোট ৪২ কোটি ৩৭ লাখ ২১ হাজার টাকার মধ্যে ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ইতিমধ্যে ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে মাটি ভরাটের জন্য মোট বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ ৬৬ হাজার ১০৬ টাকা। ৭৮ লাখ ৯৩ হাজার ঘনমিটার মাটি ভরাটের তথ্য দিয়ে এ বিল পরিশোধ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, তাঁরা ৩২ হাজার ৮৬৪ দশমিক ৬৭ ঘনমিটার মাটি ভরাট করেছেন। প্রতি ঘনমিটার মাটির জন্য ২২৯ দশমিক ২৫ টাকা হিসাবে এ কাজের মোট বিল আসে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু কাজ না করেই প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হক কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেসার্স ইউটি মং (জেভি)। আর ঠিকাদারকে এই বিল তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন জাগৃকের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদ, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. অলিউল ইসলাম, উপসহকারী প্রকৌশলী আশ্রাফুজ্জামান এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শামসুল আলম। এ ছাড়া সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও গণপূর্তের রেড শিডিউল পরিবর্তনের জন্য প্রকল্পের ব্যয় ৩৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
জানতে চাইলে জাগৃকের উপসহকারী প্রকৌশলী আশ্রাফুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি আসলে জটিল, যা করা হয়েছে সব নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। এখানে নানা ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করেছে। আমরা এ সবকিছুর জবাবও দিয়েছি। এখন নতুন করে যদি দুদক মামলা করে, তাহলে তা আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে।’
এ বিষয়ে জানতে নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে মিরপুর গৃহসংস্থান বিভাগ-২) কাওসার মোর্শেদের মোবাইলে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে প্রতিবেদনের বিষয়টি উল্লেখ করে মন্তব্য চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করা হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
Share On:
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply