খালেদা জিয়া: একজন অপ্রতিরোধ্য নেতা—
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুধু তার উত্থান দিয়েই সংজ্ঞায়িত নয়, বরং সবচেয়ে কঠিন সময়ে তার অসাধারণ আপসহীন অবস্থান দিয়েও চিহ্নিত। ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়াই রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন। সে সময় আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীসহ বড় দলগুলো প্রস্তাবটি গ্রহণ করলেও খালেদা জিয়া একাই দৃঢ় অবস্থান নেন।
খালেদা জিয়া একাই দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন। তিনি প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো নির্বাচন বৈধ হতে পারে না। দুই দশক পরে, ১/১১ সময়কালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার জন্য ‘মাইনাস-টু ফর্মুলা’ প্রয়োগের চেষ্টা করে, তখনও খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি দেশ ছাড়ার সব ধরনের চাপ প্রত্যাখ্যান করেন, যদিও শুরুতে শেখ হাসিনা সম্মতি দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এই অস্থির সময়জুড়ে তিনি দৃঢ় ছিলেন যে, তার রাজনৈতিক ম্যান্ডেট জনগণের কাছ থেকে এসেছে, কোনো বাহ্যিক শক্তি থেকে নয়। আবার ২০০৮ সালে, যখন লন্ডনে চিকিৎসার জন্য বিদেশে থাকার সুযোগ ছিল, তখনও তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন-যদিও স্পষ্টভাবে সতর্ক করা হয়েছিল যে দেশে ফিরলে তাকে কারাবরণ করতে হবে।
তার সিদ্ধান্ত ছিল অটল: তিনি বাংলাদেশ থেকে কোথাও যাবেন না-তিনি দেশের জনগণের সাথে থাকবেন, আর জনগণও তার সঙ্গেই ছিল। তার রাজনৈতিক জীবন সবসময় একটি মূল বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেছে- নিজের আদর্শ, দল এবং দেশের প্রতি আপসহীন অঙ্গীকার।
বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন একজন ফার্স্ট লেডি, একজন রাজনীতিক, একজন জাতীয় নেতা-কিন্তু সর্বোপরি তিনি ছিলেন দুই সন্তানের জননী। একজন মা হিসেবে তাকে গভীর কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তার ছেলে আরাফাত রহমান ‘কোকো’-এর মরণব্যাধির সময়ে তাকে পাশে থাকতে দেওয়া হয়নি। তিনি তাকে দেখতে পেয়েছিলেন কেবল মৃত্যুর পর। অন্য ছেলে তারেক রহমান দীর্ঘদিন লন্ডনে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে ছিলেন, মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। যে কোনো মুহূর্তে তিনি দেশ ছাড়তে পারতেন এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে-কিন্তু তিনি থেকে গেছেন, নিজের আপসহীন আদর্শ ও বাংলাদেশের প্রতি অঙ্গীকার আঁকড়ে ধরে।
কিছুই তাকে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি শুধু একজন নারী নেতা ছিলেন না-তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে বাংলাদেশের নারীরাও নেতৃত্ব দিতে পারে।
নারীর ক্ষমতায়ন—
নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি প্রথম স্থাপন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন, সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা চালু করেন এবং পুলিশ ও স্থানীয় সরকার কাঠামোতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করেন। এসব পদক্ষেপ নারীদের জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসে।
বেগম খালেদা জিয়া সেই ভিত্তিকে সম্প্রসারিত করে জাতীয় রূপান্তরে পরিণত করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনগত অধিকার এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে সবচেয়ে ব্যাপক উদ্যোগগুলোর কিছু চালু করেন।
তার যুগান্তকারী ‘ফিমেল সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম(১৯৯৪)’ গ্রামীণ মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা বিনামূল্যে করে দেয়—ফলে ভর্তি বৃদ্ধি পায়, বাল্যবিবাহ কমে যায়, জন্মহার হ্রাস পায় এবং লাখ লাখ মেয়েদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করেন ‘ফুড-ফর-অ্যাডুকেশন প্রোগ্রাম’ এবং পরবর্তীতে ‘প্রাইমারি অ্যাডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রোগ্রাম’ চালুর মাধ্যমে।
তার দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ‘হেলথ, নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রাম চালু করেন, যা মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করে এবং মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে। তিনি ১৯৯৫ সালে ‘বেগম রোকেয়া’ পদক প্রবর্তন করেন-যা বাংলাদেশের নারীদের জন্য অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মাননা।
সংসদে নারীর সংরক্ষিত আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করেন, ফলে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর প্রতিনিধিত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। নাগরিক প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও জাতীয় রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা অভূতপূর্ব মাত্রায় সম্প্রসারিত হয়।
তার সরকার ধর্ষণ, অ্যাসিড সন্ত্রাস ও যৌতুকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে-যেখানে শাস্তি দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড থেকে শুরু করে গুরুতর ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল। নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য নারী কোটা চালু করেন, ফলে মেয়েদের ভর্তি নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। তিনি ‘ন্যাশনাল ফোরাম ফর উইমেন’ এর মাধ্যমে নারীর অধিকারকে শক্তিশালী করেন এবং পুলিশ বাহিনীতে নারীর অন্তর্ভুক্তি পুনরায় চালু করেন-যা প্রথম শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
এছাড়াও তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি বজায় থাকে। তিনি রাজনীতিতে শিষ্টাচার বজায় রেখেছেন এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে বিরত থেকেছেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন দলকে একত্রিত করার ক্ষমতার জন্য তিনি কখনো কখনো ‘সব দলের নেতা’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানি বণ্টনের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৯২ সালে হোয়াইট হাউসে তিনি রোহিঙ্গা সংকটকে বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন-ফলে ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সম্মত হয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার অবদান খাটো করার চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের সংস্কার আজও বেঁচে আছে-মেয়ে ভরা শ্রেণিকক্ষে, নারী নেতৃত্বাধীন কর্মক্ষেত্রে, স্থানীয় সরকারে, পুলিশ বাহিনীতে, সংসদে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে-যেখানে বাংলাদেশের নারীরা আজ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে।
ইতিহাস কখনোই সেই পরিবর্তন মুছে দিতে পারে না, যা ইতোমধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে রূপান্তরিত করেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, কিন্তু সেটিকে জনগণের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
এমনকি আজ ২০২৫ সালে, যখন কেউ কেউ এখনো বিতর্ক করে যে নারীরা রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে পারে কি না বা তা ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না-আমাদের শুধু মনে করতে হবে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে যা প্রমাণ করেছিলেন, একজন নারী শুধু প্রধানমন্ত্রীই হতে পারেন না, তিনি গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকাও হতে পারেন। একজন গৃহিণী থেকে দেশের নির্বাচিত নেতা হয়ে ওঠা বেগম খালেদা জিয়া কেবল একটি নাম নয়. তার রাজনৈতিক জীবন বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাসের এক সংজ্ঞায়িত অধ্যায়।
সূত্র: বাসস
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply