| |
ভিডিও
ads for promotions
/
শাহেনশাহ-ই-পাকিস্তান: আসিম মুনিরের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার স্বপ্ন কি তাসের ঘর

শাহেনশাহ-ই-পাকিস্তান: আসিম মুনিরের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার স্বপ্ন কি তাসের ঘর

নিউজ ডেস্ক: নাগরিক আলো প্রতিবেদক

প্রকাশিত: 03 December, 2025

  • 28
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের বর্তমান সংবিধান গৃহীত হয়। আর এর পর থেকেই এই সংবিধানকে সইতে হয়েছে বহু আঘাত। শুরুতে এটি ছিল গণতন্ত্রের দলিল, কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু হয় অন্তহীন সব সংশোধনী, যার মাধ্যমে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান আর একনায়কতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া হতে থাকে।

তবু গত ১৫ বছর ধরে এই সংবিধান পাকিস্তানকে—অন্তত ওপরে ওপরে হলেও—বেসামরিক শাসনের এক আবরণে মুড়ে রেখেছিল। কিন্তু গত মাসে সেই ছবিটাও পাল্টে গেল। পার্লামেন্টে তড়িঘড়ি করে ২৭ তম সংশোধনী পাস হতেই সমালোচক আর বিশ্লেষকেরা একে ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’ বলে ধিক্কার জানালেন। তাঁদের মতে, এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বুকে সিপাহসালারদের আধিপত্য চিরস্থায়ী করা হলো।

পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বিরোধী জোট তেহরিক তাহাফুজ আইন-ই-পাকিস্তানের চেয়ারম্যান মেহমুদ খান আচাকজাই সোজাসাপ্টা বললেন, ‘পাকিস্তানে এখন আর কোনো সংবিধান নেই। বিচার বিভাগ নেই। নেই কোনো সামাজিক চুক্তি। এই সংশোধনী দেশের বিরুদ্ধে এক অমার্জনীয় অপরাধ। ওরা একজন মানুষকে সবার ওপর রাজা বা যেন শাহেনশাহ বানিয়ে বসিয়েছে।’

সবাই বুঝল, এই ২৭ তম সংশোধনীর আসল সুবিধাভোগী একজনই। তিনি ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি এমনিতেই দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন। তবে এখন তিনি দেশটির ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী সিপাহসালারে পরিণত হতে চলেছেন, যার হাতে থাকবে সাবেক সামরিক একনায়কদের মতো অগাধ সুযোগ-সুবিধা।

মুনির কেবল সেনাবাহিনীরই নন, নৌ ও বিমানবাহিনীরও দেখভাল করবেন। তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ নতুন করে শুরু হবে এবং তা আবারও বাড়ানোর সুযোগ থাকবে। এর মানে, অন্তত আগামী এক দশক তিনি এই পদে থেকে যেতে পারেন—যা এক নজিরবিহীন ঘটনা। তাঁকে ফৌজদারি বিচার থেকেও আজীবনের জন্য দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ, এই সংশোধনী পাকিস্তানের আগে থেকেই কোণঠাসা বিচার বিভাগের ওপর এক সরাসরি আক্রমণ। সুপ্রিম কোর্টের বদলে আসছে নতুন এক সাংবিধানিক আদালত, যার বিচারকদের বেছে নেবে সরকার। প্রতিবাদে বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারক পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের দাবি, নির্বাহী ও সামরিক ক্ষমতার ওপর যেটুকু নিয়ন্ত্রণ বাকি ছিল, সেটাও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব ভূগোলের প্রভাষক এবং পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ আয়াজ মালিক বললেন, ‘এটা অন্য মোড়কে সামরিক শাসন বা মার্শাল ল ছাড়া আর কিছুই নয়। পাকিস্তানে অতীতে সরাসরি সামরিক শাসনের সময়ে আমরা ঠিক এমনটাই ঘটতে দেখেছি।’ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কও এই সংশোধনীর সমালোচনা করে সতর্ক করলেন, এর ফলে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মূলনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, মুনির ঠিক মোক্ষম সময়ে নিজের চালটি চেলেছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে কারচুপি আর পক্ষপাতের বিস্তর অভিযোগ ওঠার পর পাকিস্তানের বর্তমান জোট সরকারকে সবাই দুর্বল, জনবিচ্ছিন্ন এবং অবৈধ বলে মনে করে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা পুরোপুরি মুনিরের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল—যাকে আয়াজ মালিক ‘মিলিটারি ভেন্টিলেটর’ বলে অভিহিত করেছেন।

এদিকে, গত মে মাসে প্রতিবেশী ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে সংঘাত শুরু হওয়ার পর মুনির জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সীমান্তে দুই পক্ষই ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। পাকিস্তান কয়েকটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার দাবি করার পর মুনির ভারতের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করেন, যার ফলে দেশজুড়ে এক উগ্র দেশপ্রেম আর যুদ্ধজয়ের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে। মালিকের মতে, ভারতের সঙ্গে এই সংঘাত মুনিরের জন্য ছিল রীতিমতো ‘স্বর্গ থেকে পাওয়া উপহার’ বা গডসেন্ড, যা তাঁকে পাঁচ-তারকা জেনারেলে উন্নীত করেছে।

মুনির নিজেকে বিশ্বনেতা হিসেবেও তুলে ধরতে শুরু করেছেন। ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনার কথিত ভূমিকার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য পাকিস্তান মনোনীত করার পর, ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মুনির নজিরবিহীনভাবে দুটি বৈঠক করেন। হোয়াইট হাউসের দরজা পাকিস্তানের জন্য এক দশক ধরে বন্ধ ছিল। মুনির সেই বরফ গলিয়ে দেশকে আবার আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে এনেছেন—এমনকি ট্রাম্পের ‘প্রিয় ফিল্ড মার্শাল’ খেতাবও জুটেছে তাঁর কপালে। এসব তাঁর অবস্থানকে আরও উঁচুতে নিয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও মুনির ছিলেন একদম সামনের সারিতে।

অনেকের মতে, মুনিরের হাতে এখন ঠিক কতটা ক্ষমতা, তা বোঝা যায় ২৭ তম সংশোধনী পাসের গতি দেখে। আগের সংশোধনীগুলো নিয়ে পার্লামেন্টে সপ্তাহের পর সপ্তাহ তর্ক-বিতর্ক ও কাটাছেঁড়া চলত। আর এটি? মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সিনেট এবং নিম্নকক্ষে প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সামান্য কিছু পরিবর্তনসহ তরতর করে পাস হয়ে গেল।

ব্রিটিশ থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউসের এশিয়া-প্যাসিফিক প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো ফারজানা শেখ বললেন, ‘বর্তমানে আমাদের এমন এক রাজনৈতিক সরকার রয়েছে যার বৈধতা এতটাই নড়বড়ে যে, সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া এর আসলে কোনো অস্তিত্বই থাকত না। আর মুনির এই সুযোগটাই পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন।’

ফারজানা শেখ জোর দিয়েই বললেন, পাকিস্তানের ইতিহাসজুড়েই দেখা গেছে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সাময়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বারবার সেনাবাহিনীকে সুযোগ করে দিয়েছে। তবে তিনি এ-ও যোগ করেন যে, ‘কিন্তু যেভাবে দুটি দল নতি স্বীকার করল, তা সত্যিই বিস্ময়কর।’

এর পরিণাম যে ভয়াবহ, সে কথাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি। ফারজানা শেখের ভাষায়, ‘এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, একটি জবাবদিহিমূলক সরকার কিংবা গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের ক্ষেত্রে এটি এক বড়সড় ধাক্কা—হয়তো সবচেয়ে বড় ধাক্কা। এই সাংবিধানিক সংশোধনী মুনিরকে দায়মুক্তির সঙ্গে কাজ করার লাইসেন্স দিয়ে দিল। পরিস্থিতিটা অত্যন্ত বিপজ্জনক।’

তিন বাহিনীর ওপর মুনির যেভাবে একচ্ছত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন, তা নিয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরেও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব নিয়ে উদ্বেগ দানা বাঁধছে। কারও কারও আশঙ্কা, মুনির—যাকে অনেকেই একজন ‘বেপরোয়া খেলোয়াড়’ এবং কট্টর মতাদর্শী হিসেবে চেনেন, বিশেষত ভারতের ব্যাপারে যার অবস্থান বেশ কঠোর—তিনি এখন পারমাণবিক কমান্ডের ওপর এমন এক নিয়ন্ত্রণ পেলেন, যার কোনো নজির নেই।

এক অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেনারেল—যিনি রোষানলে পড়ার ভয়ে পরিচয় গোপন রেখেছেন—এই সংশোধনীকে ‘বিপর্যয়কর’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি জানান, ‘নৌ ও বিমানবাহিনীর মতো অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে ইতিমধ্যেই ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। প্রস্তাবিত এই সংশোধনী প্রতিরক্ষা কাঠামোর কোনো কাজে আসবে না; বরং এটি কেবল একজন ব্যক্তিরই স্বার্থরক্ষা করবে।’

তিনি আরও যোগ করলেন, বেসামরিক সরকারের নজরদারি পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে পারমাণবিক কমান্ডকে এককভাবে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাটা ‘গভীরভাবে সমস্যাজনক’। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এই সংশোধনীর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। তিনি এসব সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী রাষ্ট্রেরই অংশ। তারা যদি ভালো কাজ করে, তবে আমরা তাদের সমর্থন করি এবং তাদের পাশে থাকি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পার্লামেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে দায়মুক্তি দিয়েছে কারণ তিনি দেশের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। তিনি সর্বেসর্বা হয়ে গেছেন—এটা নিছকই জল্পনা।’

তবে কারও কারও মতে, এই সংশোধনী কেবল একটি দীর্ঘদিনের অঘোষিত ব্যবস্থাকেই আইনি রূপ দিল—যে ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীই মূলত দেশ চালায় এবং রাজনীতির কলকাঠি নাড়ে। সেনাপ্রধান হওয়ার পর থেকে মুনিরকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ওপর দমনপীড়নের মূল কারিগর হিসেবে দেখা হয়েছে। পাকিস্তানি রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানানোর অপরাধে ইমরান খান ও পিটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ নেতারা এখন কারাগারে। বর্তমান মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী—উভয়েই মুনির মনোনীত হিসেবে পরিচিত।

কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহযোগী অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ জোর দিয়ে বললেন, ‘এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত গভীর।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি কখনো ক্ষমতাকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে পুনরায় বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়, তবে এই সংশোধনী বাতিল করা হবে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। মুনিরকে সরানো এখন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি কিংবা তাঁর পূর্বসূরি যেকোনো সেনাপ্রধানকে সরানোর চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বিশ্লেষকেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মুনিরের এই নতুন ক্ষমতার সঙ্গে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও জড়িয়ে আছে। পাকিস্তান বর্তমানে দুটি অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদী বিদ্রোহের মোকাবিলা করছে, সেই সঙ্গে প্রতিবেশী ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গেও বৈরিতা চলছে। তা ছাড়া দেশটি এমন এক তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা সমাধানে তিনি এখনো ব্যর্থ।

আয়াজ মল্লিক বলেন, মুনিরই পাকিস্তানের প্রথম জেনারেল নন, যিনি বছরের পর বছর ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনা করেছেন। দেশের শেষ সামরিক একনায়ক পারভেজ মোশাররফেরও এমন পরিকল্পনা ছিল, যা কয়েক দশক ধরে বিস্তৃত ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপক জনরোষের মুখে তাঁর পতন ঘটে। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস সাক্ষী, জেনারেলদের এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো পাকিস্তানে কখনোই শেষমেশ টেকে না। যদি অর্থের জোগান না থাকে, তবে পুরো সাজানো বাগানই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।’


Share On:

0 Comments

No Comment Yet

Leave A Reply

Nagorik Alo is committed to publish an authentic, Informative, Investigate and fearless journalism with country’s people. A highly qualified and well knowledged young team of journalists always fetch real news of the incidents or contemporary events. Providing correct news to the country's people is one kinds of community service, Keeping this in mind, it always publish real news of events. Likewise, Nagorik Alo also promised to serve the Bangladeshi people who reside in out of the country.

সম্পাদক : মোঃ ইলিয়াস হোসেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : আরিফুর রহমান info@nagorikalo.com যোগাযোগ : 30/A, সাত্তার সেন্টার ( হোটেল ভিক্টরি) লেভেল 9, নয়া পল্টন, ঢাকা--১০০০ +8801753634332

© ২০২৩ nagorikalo.com